বিগত ১৬ নভেম্বর, ২০১৭ তারিখ রাতে আমি ও আমার ২ বন্ধু এবং প্রত্যেকের স্ত্রীসহ মোট ছয়জন গ্রীনলাইন বাসে ঢাকা রাজারবাগ থেকে রওনা হলাম সিলেটের উদ্দেশ্যে। সবাই ব্যাংকার হওয়ার সুবাদে শুক্র ও শনি ছুটি তার সাথে রবি ও সোম অফিস থেকে ছুটিসহ মোট ৪ দিনের জন্য সিলেট ও শ্রীমঙ্গল যাচ্ছি। সিলেট ও শ্রীমঙ্গলে যাওয়ার আগেই হোটেল বুকিং দেয়া এবং জাফলং, লালাখাল, রাতারগুল, বিছানাকান্দি ও সিলেট থেকে শ্রীমঙ্গল যাওয়ার জন্য একটি নোয়া মাইক্রোবাস ঠিক করা ছিল। ১৭ নভেম্বর শুক্রবার সকাল ৬.৩০ মিনিটে সিলেটের কদমতলী বাসস্ট্যান্ডে নেমে সিএনজি নিয়ে হোটেলে উঠলাম। পূর্বনির্ধারিত সকাল ৮.০০ টার সময় গাড়ী এসে হাজির হল এবং আমরা সবাই গাড়ীতে উঠলাম। আজকের গন্তব্য জাফলং ও লালাখাল। মধ্যপথে নাস্তা সেরে গাড়ী চলল গন্তব্যের উদ্দেশ্য। সিলেট-জাফলং সড়কের মধ্যেই লালাখাল অবস্থিত হওয়ায় আমি চাইলাম যে, আগে লালাখাল নেমে তারপর জাফলং যাব কিন্তু ড্রাইভার বললেন আসার পথে নামলে ভাল লাগবে (যাওয়ার পথে নামাটাই ভাল ছিল কেননা জাফলং এর বিভিন্ন স্পটে অনেক হাটতে হয়, ক্লান্ত হয়ে পড়ন্ত বিকেল/সন্ধ্যায় লালাখাল ভাল লাগেনা)। সারাদিন জাফলং এ কাটানোর পরে লালাখাল আসতে আসতে প্রায় বিকেল ৫টা বেজে যায়। শীতের দিন ৫টার সময় সূর্য প্রায় ডুবো ডুবো অবস্থায় লালাখাল আর ভাল লাগেনি। পরেরদিন অর্থাৎ ১৮ নভেম্বর রোজ শনিবার নির্ধারিত সময় সকাল ৮.৩০ মিনিটে গাড়ী এসে হাজির আমরা উঠলাম রাতারগুল ও বিছানাকান্দি যাওয়ার উদ্দেশ্যে। সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলায় রাতারগুল ও বিছানাকান্দি অবস্থিত। দুইটি স্পটই খুব বেশি দিন হয়নি পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয় হয়েছে। সিলেট থেকে বিছানাকান্দি যাওয়ার পথে রাতারগুল অবস্থিত তবে মুল সড়ক থেকে ৪ কি.মি. ভিতরে। ড্রাইভার বললেন আসার পথে রাতারগুল নামাটা ভাল হবে কিন্তু এবার আমি তার সাথে একমত না হয়ে বললাম আগে রাতারগুল নামব। রাতারগুল ভাল লাগে বর্ষাকালে তবে শীতকালে একটু অন্যরকম ভাল লাগে কেননা এ সময়ে জঙ্গলের কিছু অংশে পানি থাকে আর কিছু অংশে থাকেনা। তাই প্রকৃত জঙ্গল ও সোয়াম ফরেস্ট দুইটারই অভিজ্ঞতা পাওয়া যায়। রাতারগুল থেকে বের হয়ে বিছানাকান্দি পৌছালাম ২.৩০ মিনিটের দিকে (রাস্তা ভয়ানক খারাপ ছিল-রাস্তায় পিচ-ঢালাই ছিলনা বললেই চলে)। বিছানাকান্দি পৌছে মধ্যাহ্নভোজ সেরে বিছানাকান্দির অস্বাভাবিক সৌন্দর্য উপভোগ করলাম। সৌন্দর্যের কিয়দাংশ দেখার জন্য একটি ছবি (সনি সি-৫ মোবাইলে তোলা) দিলাম। আমার কাছে বিছানাকান্দির সৌন্দর্য উপভোগের অনুভূতিটা ছিল ছেড়াদ্বীপ/নীলগিরি/সাজেক দেখার অনুভুতির মত। ভারতে অবস্থিত সাতটি পাহাড়ের মুখে এই বিছানাকান্দি অবস্থিত। অকৃত্রিম সৌন্দর্যের অধিকারী এই বিছানাকান্দির রূপের বর্ণনা দেয়ার মত ভাষা আমার নেই এই মুহুর্তে। সন্ধ্যা নামার পূর্বেই আমরা বোর্ট নিয়ে গোয়াইনঘাট এসে পৌছালাম (গোয়াইনঘাট থেকে বোর্ট এ আধা ঘন্টার মত সময় লাগে বিছানাকান্দি যেতে)। রহনা হলাম সিলেটের উদ্দেশ্যে। আমাদের সাথে মিরপুর ও কেরানীগঞ্জের দুইটা দল ছিল এবং তাদেরও গাড়ী ছিল এবং তিনটা গাড়ীই একত্রে রওনা হল তবে আমাদের গাড়ীটা সবার প্রথমে ছিল। গোয়াইনঘাট থেকে সিলেট-কোম্পানীগঞ্জ প্রধান সড়ক পর্যন্ত কিছু দূর পর পরই বাজার বা দোকান ছিল। গোয়াইনঘাট থেকে দের ঘন্টার মত পথ পাড়ি দিয়ে আমাদের গাড়ী যখন তোয়াকুল (গোয়াইনঘাট উপজেলার একটি ইউনিয়ন) বাজারের খুব কাছাকাছি (সিলেট-কোম্পানীগঞ্জ প্রধান সড়ক থেকে সর্বোচ্চ আধা ঘন্টার দুরত্ব) সময় বাজে ৬.২০-৬.৩০ মিনিট। তখন একটি ছোট ব্রিজ পাড় হওয়ার পরই দেখা গেল রাস্তার মাঝে বড় বড় পাথর ফেলানো। এই কথাগুলো আমি যখন লিখছি, ল্যাবটপ এর কি বোর্ডে একটা একটা চাপ দিচ্ছি আর আমার শরীরের প্রতিটি লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। যাইহোক রাস্তার মাঝে বড় বড় পাথর ফেলানো দেখে মনে হচ্ছিল এইবার জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ মূহুর্তের খুব কাছাকাছি। পাথরের সামনে গাড়ী থামার সাথে সাথেই রাস্তার দুইপাশ থেকে ৮-১০ জন মুখ কাপড় দিয়ে আটকানো গাড়ীর চারদিক ঘিরে ফেলল তারা। কোনকিছু বুঝার আগেই ড্রাইভারকে গাড়ী থেকে বের করে গাড়ীর চাবি নিয়ে গেল। সকলের হাতে খুব ধারালো বল্লম আর চাকু ছিল। বল্লমগুলো দেখে মনে হচ্ছিল এইগুলো ১০,০০০ বি.সি. মুভিতে ব্যবহার করা হয়েছিল; একটা কোপ দিয়ে একত্রে তিন-চার জন মারা যাবে। একজন ড্রাইভারের পিঠে চাকু ধরল আরেকজন ধারালো একটি চাকু নিয়ে গাড়ীর মধ্যে প্রবেশ করল। আমার আগে থেকেই ধারনা ছিল যে তারা আতঙ্ক সৃষ্টি করার জন্য হয়ত কাউকে আঘাত করবে যার কারণে আমি প্রায় নির্বাক হয়ে গেছিলাম। একে একে আমরা ছয় জনই আমাদের কাছে যা যা ছিল অর্থাৎ মানিব্যাগ, মোবাইল ও অন্যান্য ব্যগসহ সকল জিনিসপত্র দিয়ে দিলাম। আর আমাদের সহধর্মিনীদের কাছে কিছু স্বর্ণের জিনিস ছিল সবই খুলে দিতে হলো (বাঙালী নারী বিয়ের/এনগেইজমেন্ট এর সময় পাওয়া জিনিস নাকি খুলতে হয়না?) যাইহোক আমাদের স্ত্রীদের মত যেসব বাঙালী নারীরা আছেন যারা এইগুলো সবসময় পরে থাকেন তাদের বলছি আপনাদের এইসব জায়গায় যাওয়ার দরকার নেই, সম্পদ যাবে সাথে যাবেন আপনারাও। গাড়ীর ভিতর তন্ন-তন্ন করে খুঁজে যখন আরকিছু পাইলেন না তখন ড্রাইভারকে চাবি দিয়ে রাস্তার পাথর সরিয়ে দিলেন ড্রাইভার গাড়ী টান দিলেন। এখানে উল্লেখ্য যে, আমার ধারনা ছিল ডাকাতদল সব গাড়ীগুলো ডাকাতি করবে। আর এ লক্ষ্যে একজন ডাকাত আমাদের গাড়ীর ভিতরে ডুকে তাড়াহুড়া করছিল। তাই সবকিছু দিয়ে দিলেও কিছু ভুলবশত ফেলে রেখে যায়। অতপর, ড্রাইভারকে জজ্ঞেস করলাম ভাই পিছনের গাড়ীগুলোর কি অবস্থা? উনি বললেন গাড়ীগুলো ঘুরিয়ে পেছনের দিকে চলে গেছে। কিন্তু রাস্তা এত সরু যে আমাদের পেছনে থাকা হাই এজ গাড়ীটা ঘুরানো সম্ভব ছিলনা, ঠিক পেছনের গাড়ীতে থাকা লোকজন ফ্যামিলিসহ (৬-৮ জন) কেরানীগঞ্জ থেকে এসেছেন। জানিনা তাদের কি অবস্থা! গাড়ী ছাড়ার পর ড্রাইভারকে বললাম সোজা পুলিশ স্টেশনে যাবেন। ড্রাইভার কথামত সিলেট-কোম্পানীগঞ্জ প্রধান সড়কে অবস্থিত একটি পুলিশ ফাঁড়ীতে (গোয়াইনঘাট উপজেলার অধীন) নিয়ে গেলেন। দায়িত্বরত এস.আই. বললেন ঐ এলাকা কোম্পানীগঞ্জের অধীনে তারা জিডি কিংবা মামলা নিবেন না (জানি বাংলাদেশে এগুলো দিয়ে কেউ কোন দিন কিছু পেয়েছে কি না তা আমার জানা নেই)। আমি তাকে বললাম ভাই এটা তোয়াকুল বাজারের পাসেই আর এটাতো গোয়াইনঘাটের মধ্যেই। তিনি বললেন না আপনাদের ঘটনাটা যেখানে ঘটেছে ঐ জায়াগাটা কোম্পানীগঞ্জের অধীন। তিনি যেভাবে বলতে ছিলেন মনে হলো তিনি আমাদের সাথে ছিলেন (পরে অবশ্য জানতে পারলাম জায়গাটা গোয়াইনঘাটের অধীনেই ছিল। এস.আই. সাহেবকে আমার পরিচয় দিলাম এবং বললাম আমার হলের সাবেক রুমমেট ডিবিতে সিনি.এ.সি হিসেবে আছে, আমার প্রাক্তন কলিগ বেশ কয়েকজন এ.এস.পি এবং আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের খুব ঘনিষ্ট কয়েকজন বন্ধু এ.এস.পি.। কোন কিছুর মাধ্যমেই তাকে জিডি করার জন্য রাজি করাতে পারলাম না। নিজেকে একটু হীনমন্য ভাবায় আর কাউকে ফোন দেয়া হলো না। পুলিশ ফাঁড়ী থেকে কোম্পানীগঞ্জ থানার দূরত্ব প্রায় দুই ঘন্টা হওয়ায় আর জিডি করতে যাওয়া আর হলো না। পরের দিন সকালে শ্রীমঙ্গলের পরিবর্তে ঢাকার উদ্দেশ্যে রাওনা হলাম।
এই ভ্রমণ থেকে আমার পর্যবেক্ষণগুলো নিম্নরূপ:
১. বাংলাদেশের পর্যটন এখনও প্রাতিষ্ঠানিকিকরণ হয়নি (আমার ধারণা এলাকাবাসীর মাধ্যমেই ডাকাতি হয়েছে এবং আমাদের ড্রাইভারও জড়িত ছিলেন)।
২. ভ্রমণকালে বাঙালী নারীর বাঙ্গালিত্ব কিছুটা পরিহার করতে হবে।
৩. দুর্গম জায়গায় যাওয়ার পূর্বে অবশ্যই স্থানীয়দের কাছে থেকে তথ্য এবং এলাকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নাম্বার নিয়ে রাখুন (ফিরতে বিলম্ব হতে তাদের সহায়তা নেয়ার জন্য)।
৪. দুর্গম জায়গা থেকে সন্ধ্যার পূর্বে অবশ্যই ফিরে আসুন (বাংলাদেশের দুর্গম স্থানে বসে সূর্যাস্ত দেখা আপনাদের সাথে মানায় না)।
(সংগৃহীত)
ভালো থাকুন | School of Awareness
No comments:
Post a Comment